কাজিপুরে সুদখোরের কবল থেকে বাঁচতে মানববন্ধন

শাহজাহান আলী, কাজিপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি :
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার সুদের কারবারি আব্দুল হামিদের খপ্পর থেকে পরিত্রাণ চেয়ে মানববন্ধন করেছেন ভুক্ত ভোগীরা।

সুদখোর আব্দুল হামিদ কাজিপুর উপজেলার সাতকয়া গ্রামের মৃত আবুল হোসেন মণ্ডলের ছেলে।

মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় উপজেলার শিমুলদাইড় বাজারে এই মানববন্ধনে অংশ নেন সুদের খপ্পরে পড়া ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসী।

মঙ্গলবার শিমুলদাইড় বাজারে ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধন চলাকালে ভুক্তভোগী শিমুলদাইড় গ্রামের আনসার আলী জানান, হামিদের কাছ থেকে তিনি কোন প্রকার টাকা নেননি। কিন্তু তার নামে ৬ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছে মর্মে একটি মামলা করেছেন। এরপর আমার নামে ডাকাতি মামলাও করেছে। আমার তদবিরের কোন লোক নাই। তাই সেই মামলায় ছয় মাস জেল খেটেছি। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

ছালাভরা গ্রামের ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন সুদখোর হামিদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। বিপরীতে হামিদ একটি সাদা ব্যাংক চেকে সাক্ষর নেন।

পরে ঋণকৃত টাকা পরিশোধ করার পরেও চাহিদা মোতাবেক আরও টাকা চায়। না পেয়ে তিনি জামানত হিসেবে নেয়া চেকে ঋণের টাকা বসিয়ে তার ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। চেক ডিসঅনার হলে তিনি সেই চেকের কপি দিয়ে আমার নামে দেড় লক্ষ পাওনা দেখিয়ে আদালতে মামলা দেন।

মঙ্গলবার সরেজমিন সাতকয়া গ্রামে গেলে বেরিয়ে আসে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

একাধিক ভূক্তভোগী জানিয়েছেন, সুদখোর আব্দুল হামিদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকে বসতভিটা, এমনকি ব্যবসাও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হামিদের এক প্রতিবেশি জানান, চার বছর পূর্বে বর্শিভাঙ্গা গ্রামের আল মাহমুদ নামের একজন তার নিকট থেকে ঋণ নিয়েছিলো। পরে পরিশোধ করতে বিলম্ব হওয়ায় তাকে হুমকি ধামকি দেয় এবং অপমান করে। সেই দুঃখে ওই ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।

পরে অনেক দেন দরবার করে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছেন আব্দুল হামিদ। আবার অনেকে তার দেয়া মামলার কারণে বাড়ি ছেড়েছেন। এরই মধ্যে অনেক ঋণ গ্রহিতা নির্দিষ্ট টাকা পরিশোধ করলেও হামিদের দাবিকৃত অতিরিক্ত টাকা দিতে না পারায় আদালতে তাদের নামে চেক ডিজঅনার এর মামলা হয়েছে।
এদেরই একজন উপজেলার ছালাভরা গ্রামের মৃত সেকেন্দার আলী’র পুত্র ঝুট ব্যবসায়ী আশাদুল আলম।

তিনি জানান, কয়েক বছর আগে ব্যবসায়িক জরুরি প্রয়োজনে আব্দুল হামিদের নিকট থেকে ৩’লক্ষ টাকা সুদসহ প্রদানের শর্তে খালি চেকে স্বাক্ষরের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। শর্তমত সুদসহ সমস্ত টাকা পরিশোধ করলেও চেক ফেরত না দিয়ে উল্টো নতুন করে তার নিকট ৮ লক্ষ টাকা দাবি করে উকিল নোর্টিশ পাঠিয়েছে।

কবিহার গ্রামের আব্দুস সোবহানের ছেলে কোরবান আলী জানান, তিনিও হামিদের নিকট থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা নেন। গ্যারান্টি হিসেবে তিনি উত্তরা ব্যাংক লিঃ শুভগাছা শাখার একটি স্বাক্ষরযুক্ত সাদা চেক (নং এসবিবি-০১০০১৮৫) হামিদকে প্রদান করেন।
কিন্তু পুরো টাকা পরিশোধ করার পরেও তিনি চেক ফেরৎ না দিয়ে ব্যাংকে জমা করেন। চেক ডিসঅনার হলে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি হাওলা বাবদ ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দাবি করে আব্দুল হামিদ তার নামে আদালতে মামলা দিয়েছেন।

ক্ষুদ্র ঝুট ব্যবসায়ী ছালাভরা কুনকুনিয়া গ্রামের মৃত মজিবর রহমানের ছেলে নাসির উদ্দিন টিক্কা জানান, তিন বছর পূর্বে হামিদের নিকট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নেন। এসময় জামানত হিসেবে তার স্বাক্ষর করা যমুনা ব্যাংক লিঃ এর (টাকার অংক না বসানো, জেসিএ-নং-০৬৩৯২৭৬) চেক হামিদকে প্রদান করেন।

ইতোমধ্যে হামিদের সব টাকা তিনি পরিশোধ করেছেন। পরে চেক ফেরত চাইলে তার নিকট থেকে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা চায়।

টিক্কা জানান, তার (হামিদের) বাড়তি চাওয়া টাকা দিতে পারি নাই তাই সে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আমার নামে আদালতে দেড় লক্ষ টাকা দাবী করে মামলা করে। এখন ভয়ে আছি মামলা চালামু, না ব্যবসা মন দিয়া করমু।
শিমুলদাইড় বাজারের আরেক ঝুট ব্যবসায়ী মৃত শাহজাহানের পুত্র শাহিন কয়েক বছর পূর্বে ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে হামিদের নিকট থেকে ৩ লক্ষ টাকা নেন।

এসময় জামানত হিসেবে স্বাক্ষরযুক্ত চেক (যমুনা ব্যাংক লিঃ নং-জেবিএস-৯১০৩৭৫৭) নেন হামিদ। সব টাকা শোধ করার পরেও তার নিকট হামিদ আরও তিন লক্ষ টাকা দাবি করে।

ভুক্তভোগি শাহিন জানান, ওই দাবীকৃত টাকা না দিলে হামিদ আমার সাদা চেকে বারো লক্ষ টাকা বসিয়ে ব্যাংকে জমা করে ডিসঅনার করেছে। পরে আমার নামে মামলা দিয়েছে। এরইমধ্যে আমি নোর্টিশ পেয়েছি। ভয়ে আছি কি হয়।

এমনি করে আব্দুল হামিদের ফাঁদে পড়েছেন গাড়াবেড় গ্রামের ফরিদুল ইসলাম মাস্টার, হেলাল উদ্দিন, বেলতৈল গ্রামের সানোয়ার, পরানপুর গ্রামের আব্দুস সোবহান, আব্দুল হালিমসহ শতাধিক মানুষ।

তবে কে এই হামিদ?

আব্দুল হামিদ। বয়স ষাট পেরিয়েছে। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের সাতকয়া গ্রামের মৃত আবুল হোসেন মন্ডলের ছেলে আব্দুল হামিদ। নিজে উপার্জনের জন্যে তেমন কোনো কাজই করেন না। ঋণ গ্রহিতাকে নিজের স্বাক্ষর করা খালি চেক (ব্লাঙ্ক চেক) কিংবা জমির মূল দলিল জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়। অনেক সময় ঋণ গ্রহিতার নিকট থেকে ফাঁকা (সাদা) স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরও নিয়ে রাখেন।

পরে ঋণ গ্রহিতা নির্দিষ্ট সময়ে সুদসহ সমুদয় পাওনা পরিশোধ করলেও তার মুক্তি মেলেনা। আব্দুল হামিদ ঋণ গ্রহিতাদের নিকট থেকে নেয়া স্ট্যাম্প, জমির কাগজ কিংবা চেক ফেরত নিতে এককালিন মোটা টাকা দাবী করেন।

চাহিদা মোতাবেক টাকা না পেলে তিনি জামানত হিসেবে নেয়া চেক ফেরত না দিয়ে উল্টো ঋণের পুরো টাকাই তিনি চেকে বসিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। চেক ডিসঅনার হলে তিনি সেই চেকের কপি দিয়ে ওই ব্যক্তির নামে গৃহিত ঋণের তিনগুণ টাকার উল্লেখ করে আদালতে মামলা দেন।

কোনো প্রকার সরকারি অনুমোদন ছাড়াই প্রায় দেড়যুগ ধরে সাধারণ মানুষ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আব্দুল হামিদ এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

অভিযোগের বিষয়ে দাদন ব্যবসায়ি আব্দুল হামিদ বলেন, আমি সাধারণত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টাকা ঋণ হিসেবে দিয়ে থাকি। তখন ঋণ গ্রহিতারাই আমাকে স্ট্যাম্প কিংবা চেক লিখে দেয়। এখানে আমিতো তাদের সহায়তা করি। চেক নিয়ে টাকা ঋণ দেয়াটা বৈধ কিনা জানতে চাইলে উত্তর এড়িয়ে তিনি বলেন আমার সব কাগজপত্র আছে। এ কারণে উনাদের নামে মামলা করেছি।

তবে এব্যাপারে কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হাসান সিদ্দিকী জানান, অনুমোদন ছাড়া ঋণ প্রদান করে সুদ আদায় করা কিংবা চেক নেয়া অবৈধ। চেক যারা দিয়েছেন তারাও সচেতন নন। এ ধরণের লেনদেনে বিষয়ে সবারই সর্তক থাকা জরুরি।