ঠাকুরগাঁওয়ের বিদ্যালয়ে আঁকা হয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিকৃত প্রতিকৃতি

আপেল মাহমুদ, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: অনুসন্ধানবার্তা
নজরকাড়া উজ্জ্বল রঙে রাঙোনো বিদ্যালয়ের সব দেয়াল। দেয়ালে আঁকা হয়েছে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতিকৃতি। কিন্তু দেয়ালে আকাঁ মুখগুলোর সাথে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রকৃত চেহারার কোন মিলই নেই।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য মতে, সদর উপজেলায় সরকারী ৬০৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সেই সব বিদ্যালয়ে ধাপে ধাপে স্কুল লেভেল ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান (স্লিপ) তহবিলের আওতায় ৪০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই বরাদ্দ দিয়ে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মানোন্নয়ন, অগ্রাধিকারভিত্তিক ক্ষুদ্র সংস্কার ও অসহায় শিক্ষার্থীদের সহায়তাসহ বিভিন্ন কাজ করার কথা ছিল।

কিন্তু ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক বিদ্যালয়ে স্লিপের তহবিল দিয়ে বিদ্যালয় ভবন রঙ করানো ও দেয়ালে দেয়ালে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট নানা চিত্র, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতিকৃতি, জাতীয় পাখি, পশু, ফল ও ফুলসহ নানা ধরনের ঐতিহাসিক নির্দেশনের ছবি আঁকা হয়েছে।

সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার কাশিডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুরাতন ঠাকুরগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চাটাই পুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ আসান নগর নদীর ডাঙগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমলাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘনিবিষ্ণুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝলঝলি পুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় ব্যঙ্গচিত্র। বিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া, কবি সুফিয়া কামাল, সাত বীরশ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতিসহ জাতীয় পাখি, পশু, ফল, ফুলসহ ঐতিহাসিক নির্দেশনের ছবি।

কিন্তু সেখানে জাতির এসব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মুখগুলো অনেকটাই বিকৃত করে আঁকা হয়েছে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার দক্ষিণ আসান নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের দেয়ালে আঁকা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়াসহ সাত বীরশ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতি।

ওই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী লাকী আকতারকে দেয়ালে আঁকানো বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ছবি দেখালে সেও চিনতে পারেনি। লাকী বলে, আমাদের বাংলা বইয়ে তিনজন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ, নুর মোহাম্মদ শেখ ও মোহাম্মদ রুহুল আমিনের ছবির সঙ্গে তাঁদের সাহসিকতার কথা বর্ণনা দেওয়া আছে। কিন্তু বইয়ের ওই ছবি আর বিদ্যালয়ের দেয়ালে আঁকা ছবির মধ্যে কোন মিল নেই।

দক্ষিণ আসান নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে প্রতিকৃতিগুলো এঁকেছেন হরি গোপাল নামে সদর উপজেলার রুহিয়া বাজারের এক চিত্রশিল্পী। তিনি জানান, ছবি আঁকার বরাদ্দ খুবই কম থাকে। অনেকটাই তড়িঘড়ি করে ছবি এঁকে শেষ করতে হয়। এতে অনেক সময় ছবি এদিক ওদিক হয়ে যায়। তবে তাঁর আঁকা ছবিগুলো বিকৃত হয়েছে এমনটি তিনি মানতে রাজী নন।

বিদ্যালয়ে ছবিগুলো আঁকার পরে, তা দেখে দক্ষিণ আসান নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিকুঞ্জ কুমার বর্মনের মনেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ছবির মান খারাপ হলেও মেনে নিয়েছি। তবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ছবি তিনবার চেষ্টা করেও ভালো করতে ব্যর্থ হয়েছে চিত্রশিল্পী। তাই শিল্পীর পাওনা তিনহাজার টাকা আটকে রেখেছি।

দারাজগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়ন্তের ভাষ্যমতে, বিদ্যালয়ের দেয়ালে আঁকা বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিগুলোর চেহেরা অন্য রকম মনে হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যালয়ে আঁকা ব্যক্তিদের ছবির নিচে নাম লেখা না থাকায় সেই ছবিটা কার তা বুঝতে পারেননি।

বিদ্যালয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিকৃত প্রতিকৃতি আঁকা প্রসঙ্গে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক খাদেমুল ইসলাম যাদু বলেন, আমার জানামতে শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতে বিদ্যালয় ভবনে তাঁদের প্রতিকৃতি আঁকার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্যালয়ে আঁকা সেই সব প্রতিকৃতি দেখে খুব খারাপ লাগছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতিকৃতি কোনো যুক্তিতেই বিকৃত করে আঁকার সুযোগ নেই। বিদ্যালয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতিকৃতি আঁকার সময় যেনতেন মানের শিল্পীদের নয়, দক্ষ চিত্রশিল্পীদের বেছে নেওয়া উচিত ছিল।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও গবেষক মনতোষ কুমার দে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ওই ছবিটিকে আমি বিকৃত বলবো না। আমি বলবো শিশুদের অপরিপক্কতার কারণে ছবিটি সেই মানের হয়নি। কিন্তু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো তহবিলের টাকা খরচ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতিকৃতিগুলো দক্ষ হাতেই আঁকিয়েছেন। সেগুলোর গড়মিল কখনই গ্রহন করা যায় না। এটা গুরুতর অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

তবে এবিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রুনা লায়লা বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। বিদ্যালয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতিকৃতি কোনোভাবেই যেনতেনভাবে আঁকা কাম্য নয়। সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হবে।

এবিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) কামরুন নাহার বলেন, বিদ্যালয়ে আঁকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রতিকৃতিগুলো যাচাই করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।