বিলুপ্তির পথে ধুনটের প্রচীন ঐতিহ্য
এখন আর গ্রাম গঞ্জে তেমন চোখে পড়ে না, ঘোড়া বা গরুর গাড়ি। বর্তমানে আধুনিকতার যান্ত্রিক ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের এসব যানবাহন। বগুড়ার ধুনট উপজেলার চান্দিয়ার গ্রামের মেঠো পথে ধান বোঝাই ঘোড়ার গাড়ীতে করে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন এক কৃষক। -অনুসন্ধানবার্তা

ইমরান হোসেন ইমন, অনুসন্ধানবার্তা:
অতীত স্মৃতির সঙ্গে মিশে থাকা প্রচীন ঐতিহ্যগুলো আধুনিক সভ্যতার মানুষজন পরিচিতি না হলেও বয়োজৈষ্ঠদের মনে এখনও দোলা দেয়।

প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে ধুনটের ইতিহাস ও সংস্কৃতির আয়নায় ধুনট উপজেলাবাসী আসল আকৃতি ও রূপ দেখতে পায়।

তবে কালের পরিবর্তন ও সময়ের ব্যবধানে নতুন প্রজন্ম তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির পেরির গাছা হারিয়ে ফেলেছে।

তন্মধ্যে গরু মহিষের গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, পালের নৌকা, বাইছের নৌকা, পালকি, ডুলি, তবলা সহ অসংখ্য প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে এই ধুনট উপজেলায়।

এসব প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে ঘোড়া বা গরুর গাড়ি এবং পালের নৌকা ছিল অন্যতন। এই দুটি বাহনই ছিল প্রাচীন মানুষের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা।

কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার যান্ত্রিক ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঘোড়ার গাড়ি কিংবা গরুর গাড়ি। সেই সাথে হারিয়ে গেছে পালের নৌকাও। এখন আর গ্রাম গঞ্জে তেমন চোখে পড়ে না, ঘোড়া বা গরুর গাড়ি কিংবা পালের কোন নৌকা।

কিন্তু একসময় উত্তর জনপদের বিভিন্ন উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি বাহনের সরগম অস্তিত্ব ছিল সর্বত্র। ছিল এই ঘোড়ার গাড়ির কদরও।

বিয়ে এবং যে কোন উৎসবে ঘোড়া বা গরুর গাড়ি ছাড়া অনুষ্ঠানই যেন অসম্পর্ন হয়ে যেত সেই সময়। কিন্তু আধুনিকতার এই যুগে হারিয়ে যাচ্ছে ঘোড়া বা গরু-মহিষের গাড়ি কিংবা পালের নৌকাও।

বর্তমানে আধুনিক এই যুগে দু-একটা গ্রামে গঞ্জে হাতে গোনা দু-একটা ঘোড়া গাড়ি দেখা গেলেও গরু-মহিষের গাড়ী কিংবা পালের নৌকা আর দেখাই মেলে না। দুই এক জায়গায় ঘোড়ার গাড়ী দেখা মিললেও তাও আবার জরাজীর্ন অবস্থায় দেখা যায়। তবে আজ শহরের ছেলে মেয়েরা তো দুরে থাক গ্রামের ছেলে মেয়েরাও ঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়ির সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নয়।

কিন্তু এক সময় অনেকেরই এই গাড়িগুলো ছিল উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন। সেই সঙ্গে দূও দূরোতে যাতায়াতের জন্যও ছিল এক মাত্র ভরসা।

তবে এক সময় ধুনট উপজেলার মেঠাপথে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের জন্য ঘোড়ার গাড়ি ছিল অন্যতম। তখন ঘোড়া গাড়ি দুই ভাবে তৈরী করা হতো। তন্মধ্যে মালবাহী ঘোড়ার গাড়ি এবং টমটম ঘোড়ার গাড়ি।

মালবাহী ঘোড়ার গাড়ি ছিল গরু মহিষের আদলে তৈরী। তবে দুইটি গরু বা মহিষের পরিবর্তে এই গাড়িতে একটি ঘোড়া ব্যবহার ও কাঠের পরিবর্তে টায়ারের চাকা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু টমটম নামক ঘোড়ার গাড়িতে কাঠের তৈরী এবং লোহার পাত বিশিষ্ট চাকা ব্যবহার করা হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত ধুনট-শেরপুরের যাতায়াতের আরামদায়ক ও সৌখিন বাহন ছিল টমটম। অনেক সময় সৌখিন লোকেরা ঘোড়ার গাড়ী রং বেরং এর কাগজ দ্বারা সাজিয়ে আনন্দ ভ্রমণ করতেন। বর্তমানে সেই ঘোড়ার গাড়ী এখন বিলুপ্তির পথে।

গতকাল ধুনট উপজেলার চৌকিবাড়ী ইউনিয়নের চান্দিয়ার গ্রামের মেঠো পথে দেখা যায়, আবু বক্কর নামে এক ব্যক্তি ধান বোঝাই ঘোড়ার লাগাম টেনে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। মাদ্রাসা পড়ুয়া ১০ বছরের শিশু ঘোড়ার গাড়ীর উপড়ে বসে রয়েছে। আর বাবা ঘোড়ার গাড়ীর লাগাম টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এর পিছু পিছু পায়ে হেঁটে আসছিলেন তার স্ত্রীও।

বিলুপ্তির পথে ধুনটের প্রচীন ঐতিহ্য

আবু বক্কর জানান, আগে আমার বাপ-দাদারা এই ঘোড়ার গাড়ী চালিয়ে আমাদের সংসার চালাতেন। কিন্তু এখন আর বাপ-দাদারা না থাকলেও ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু আগের দিনে ঘোড়ার গাড়ির কদর থাকলেও এখন আর নেই। তাই জমি থেকে ফসল পরিবহন এবং ঘৌড় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েই জীবিকা চালাই।

তবে এক সময় যেমন ঘোড়া বা গরুর গাড়ির কদর ছিল, তেমনি কদর ছিল পালের নৌকারও। পালের নৌকা মাঝি বৈঠা টানতে টানতে দূরতভাবে যেতো। আর যদি বাতাস অনূকুলে থাকত তাহলে নৌকাতে পাল তুলিয়ে দিয়ে বাতাসের অনুকূলে ভাসিয়ে দিত। আর হালের মাঝি হাল ধরে মনের আনন্দে গান ধরত। আবার অনেক সময় নববধুরা পালের নৌকায় চড়ে বাপের বাড়ি যেত। নববধুর আরোহী নৌকা দেখতে কিশোর কিশোরীরা উঠান ছেড়ে দৃশ্য দেখতো।

ধুনট উপজেলার পূর্বপাশে যমুনা, ধুনট সদরের বুক চিরে ইছামতি, পশ্চিমে বঙ্গালী নদী সহ আরো কিছু শাখা নদী থাকায় পালের নৌকার কদরও ছিল অন্যতম। কিন্তু বর্তমানে ইঞ্জিন চালিত নৌকার দৌড়াত্বে ধুনট উপজেলা থেকে ঐতিহ্যবাহী সেই পালের নৌকাও হারিয়ে গেছে।

ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের শিমুলবাড়ী গ্রামের চাঁন মিয়া জানান, এক সময় তার বাপ-দাদারা যমুনায় নৌকার পাল তুলে ধুনট থেকে সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরে যেতেন। সেই যাত্রী নামিয়ে দিয়ে তার বাবার বাড়ি আসতে কত দিন একমাসও লেগে যেতো। এখন বাপ দাদার পেশা ধরিয়ে রাখতে এখন ইঞ্জিন চালিত নৌকায় শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

ধুনটের ইতিহাস ও সংস্কৃতিক গ্রন্থাগারের লেখক ও কাজিপুর আমিনা মনসুর ডিগ্রি কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গবেষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, নিজ নিজ এলাকার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সকলের সঠিক জ্ঞানার্জন এবং তা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্ম প্রচীন এসব ইতিহ্য ও ইতিহাস থেকে অনেকটাই ভষ্যিতের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।

ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জানাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।