পদ্মা সেতু আমাদের অহংকার -কৃপা সিন্ধু বালা

শ্রোতস্বিনী পদ্মা, খরশ্রোতা পদ্মা বিরহে কাঁদছে। আমি পদ্মা পাড়ের মানুষ, ইতিহাসের এই নজিরবিহীন সাক্ষীর দিনে কিছু কথা লেখার শুরুতেই শিল্পী মোঃ আব্দুল আলীমের গানের কথা মনে পড়ে গেল- ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী রে, তোর কাছে সুধাই, বল আমারে তোর কিরে আর কুল কিনারা নাই, পাড়ের আশায় তাড়াতাড়ি সকাল বেলা ধরলাম পাড়ি, আমার দিন যে গেল সন্ধ্যা হল তবু না কুল পাই। কুল কিনারা নাই, ও নদীর কুল কিনারা নাই। পদ্মা তোর তুফান দেইখা পরান কাঁপে ডরে ফেইলা আমায় মারিস তোর সর্বনাশা ঝড়ে…………….।’

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই দিনে কর্মস্থল থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ র‌্যালি শেষে আলোচনা সভায় দাড়িয়ে কিছু কথা বলতেই নিমিষেই আনন্দাশ্রু নির্গত হলো। মনে হলো এক বিশাল প্রাপ্তির দিন আজ। তাই ভাবাবেগেই আপ্লুত হয়ে পড়লাম ‘বিশাল পদ্মার বুকে আজ নির্মিত হলো পদ্মা সেতু।’ অকল্পনীয় অভাবানীয়। যখন আমরা বাড়ী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করতাম শিমুলবাড়ী ঘাটে এসে ফেরির জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর ফেরিতে উঠে ঢাকার পাড়ে মাওয়া প্রান্তে কখনো ২ ঘন্টা বা কখনো ৩/৪ ঘন্টা, কিংবা তারও বেশী সময় লেগে যেত। অদ্ভুত এক যন্ত্রনা নিয়ে মাওয়া প্রান্তে পৌঁছাতাম। আবার কখনো পিতা তার পুত্রকে নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা করে মাওয়া প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পুত্রের মৃত্যু চোখের সামনেই দেখতে হতো।

কত লোক র্দীঘ পথের পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়ে তাদের আত্মীয় স্বজনকে হারিয়েছে তার ইয়াত্তা নাই। আবার কখনো কখনো প্রমত্তা শ্রোতস্বিনী পদ্মায় বহু লোক লঞ্চ বা স্পীডবোড ডুবিতে মারা গিয়েছে। পদ্মা যখন পাড়ি দিতাম, ভাবতাম এই পদ্মার বুকে কি কখনো ব্রীজ করা সম্ভব! কেউ কি পারবে এই অসম্ভব কে সম্ভব করতে। অসাধ্যকে সাধন করতে সৃষ্টিকর্তার অপার করুণায় ৭/৮ বছর আগে ক্ষণজন্মা পুরুষের ক্ষণজন্মা মেয়ে জাতির জনকের কন্যা আমাদের সক্ষমতার প্রতীক, আমাদের অহংকার, আমাদের অনুভূতির ঠিকানা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে প্রথম উচ্চারিত হলো বিশাল পদ্মার বুকে পদ্মা সেতু করব। পদ্মা সেতু করতে পারলে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে, নিত্য নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠবে, কর্মসস্থান সৃষ্টি হবে।

আমরা দক্ষিণ বাংলার একুশ জেলার মানুষ এক স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে অদম্য সাহস শক্তি যোগায়। বিশ্ব ব্যাংক সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসলেও দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রে বিশ্ব ব্যাংক বদনাম দিয়ে চলে তো গেলই, আবার সেই বদনাম দেশের বহু প্রতিষ্ঠিত লোকের সম্মানহানী করে চলে গেল। বিশ্ব ব্যাংক কি পারবে সেই যাদের সম্মানহানী করেছে তাদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে, পারবে কি আর সেই ফেলে আসা দিনগুলি ফিরিয়ে দিতে। বিশ্ব ব্যাংক চলে যাওয়ায় আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলেন আরো অদম্য বাসনা নিয়ে দেশবাসির দোয়া নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করলেন।

সকল ষড়যন্ত্র, সকল বাধা অপেক্ষা করে সকল প্রতিকুলতাকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ বাংলার মানুষের অনুভূতিকে হৃদয়ে ধারণ করে পদ্মা সেতুর কাজ সমাপ্ত করে আজ ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনী আমাদের অহংকার। আপনার উন্নয়নে অদম্য গতিতে ছুটে চলছে বাংলাদেশ, আপনাকে পদ্মা পাড়ের মানুষ হিসেবে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অনেক অনেক খুশি হত। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময় এই বিশাল পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞে প্রথম থেকেই শেষ পর্যন্ত প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ, প্রযুক্তিবিদ, উপদেষ্টা, দেশী বিদেশী প্রকৌশলী, কর্মকর্তা, কর্মচারী, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, যারা দিনরাত্র কাজ করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই সম্মানিত মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ, জাতীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ। যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সহায়তা করেছে, ইতিহাসের এই সাক্ষীর দিনে তাদের প্রতি আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন রইল।


লেখক:
কৃপা সিন্ধু বালা
অফিসার ইনচার্জ
ধুনট থানা, বগুড়া।