ঠাকুরগাঁওয়ে অসময়ের বৃষ্টিতে নুয়ে পড়েছে ধান ক্ষেত

আপেল মাহমুদ, ঠাকুরগাঁও থেকে :
বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের কারণে গত সোমবার রাত থেকে ঠাকুরগাঁও জেলায় টানা বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এতে আমন ধান ক্ষেত নুয়ে পড়েছে। ফসলের মাঠ পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি দ্রুত না কমলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।

তবে কৃষি বিভাগ বলছে, জেলায় যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে ফসলের খুব একটা ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকেরা জানান, সোমবার রাত থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয়। মাঝেমধ্যে বৃষ্টির সঙ্গে চলে দমকা হওয়া। কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি, আবার কখনো প্রবলবেগে বৃষ্টি হয়। বুধবারও থেমে থেমে ভারি বৃষ্টি চলে। এতে জেলার আমন ও রবি ফসলের মাঠ পানিতে তলিয়ে যায়।

ঠাকুরগাঁওয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কোনো কার্যালয় নেই। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃষ্টিপাতের রেকর্ড করে থাকে। তবে ছুটির কারণে গত সোমবার থেকে কী পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, তা জানা সম্ভব হয়নি।

তবে গত ২৪ ঘন্টায় জেলায় গড়ে ৬৫ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষিবিভাগ। আর দিনাজপুর আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঠাকুরগাঁওয়ে ১৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নারগুন ইউনিয়নের কহরপাড়া, দানারহাট, সালন্দরের শিংপাড়া, আউলিয়াপুরের কচুবাড়ি হাটপাড়া,আকচার বঠিনা ও ঢোলারহাট এলাকার বড়দ্বেশ্বরীসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে,সেই সব এলাকার মাঠ-ঘাট তলিয়ে গেছে।

ডুবে গেছে আমন ক্ষেতের ধান, মূলা, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, করলা, লাউ, লাল শাক সহ শাক-সবজির ক্ষেত। বিঘা বিঘা ক্ষেতের ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। দুই একটা ছাড়া প্রায় সব ক্ষেতের ধানই মাটিতে হেলে পড়েছে। এসব জমির ধান ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই কাটা হয়ে যেত।

ঠাকুরগাঁওয়ে অসময়ের বৃষ্টিতে নুয়ে পড়েছে ধান ক্ষেত

আউলিয়াপুরের কচুবাড়ি হাটপাড়া এলাকার কৃষক বিকাশ রায় চৌধুরী চার একর জমিতে আমন আবাদ করছেন। ১৫ দিন পরই ক্ষেতের ধান কাটার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু টানা বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়ায় তার থেতের ধানগাছ মাটিতে নুয়ে পড়েছে। তাতে ফলন পাওয়া যাকে কিনা, তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন তিনি।

বিকাশ রায় চৌধুরী বলেন, কত কষ্ট করে আমরা ফসল আবাদ করেছি। আর যখন কাটার সময় হলো, তখন বৃষ্টি পাকা ধানে মই দিয়ে দিলো। এলাকার প্রায় সব ক্ষেতের ধানের একই অবস্থা বলে জানালেন বিকাশ রায়।

সালন্দরের শিংপাড়া গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছিলেন। ক্ষেতের ধানগাছে কেবল ফুল এসেছে। এঅবস্থায় বৃষ্টিতে ক্ষেতের ৮০ ভাগ ধান গাছ মাটিতে শুয়ে পড়েছে। বৃষ্টি না কমলে আমার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচার বঠিনা এলাকাতেও আমন ক্ষেতের ধানগাছ নুয়ে পড়েছে। সেখানে কথা হয় আমন চাষি জগেশ্বর বর্মণের সঙ্গে। তিনি বললেন, শুয়ে পড়া ধান গাছে কয়েকদিনের মধ্যেই পোকার আক্রমণ দেখা দিবে। এতে ধানে চিটা হয়ে যাবে। আমাদের কপালে যে কী আছে, বুঝতে পারছি না।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতালা গ্রামের আরেক কৃষক আবেদ আলী বলেন, ধারদেনা ও ঋণ করে জমিতে ধান আবাদ করেছিলাম। ক্ষেতের ধান নষ্ট হয়ে গেলে, কী দিয়ে তা পরিশোধ করব আর কীভাবে পরিবারের ভরণপোষণ করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।

টানা এই বৃষ্টিতে জেলার আমন ধান ক্ষেত শুধু ক্ষতির মুখে পড়েছে, তা নয়। ডুবে গেছে বিস্তৃর্ণ সবজি ক্ষেতও।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ইয়াকুবপুর, বড়দ্বেশ্বরী ও পাটিয়াডাঙ্গী এলাকা সবজি চাষের খ্যাতি রয়েছে। সেসব এলাকায় দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ শষা, ঝিঙে, লাউ, বেগুন, মূলাসহ নানা সবজির ক্ষেত পানিতে ডুবে রয়েছে। কোনো কোনো কৃষক ক্ষেতে জমে থাকা পানি বের করে দিতে ব্যস্ত।

সবজিচাষি যতিন রায় বলেন, আমাদের গ্রামসহ আশপাশের এলাকার দেড় শতাধিক চাষির সবজি ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। পানি না সরাতে পারলে এসব ফসল নষ্ট হয়ে যাবে।

এদিকে এই বৃষ্টিকে ধানের জন্য আর্শিবাদ হিসেবে দেখছেন রানীশংকৈল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় দেবনাথ। তিনি বলেন, জেলার অধিকাংশ কৃষকের আমন ধান এখন দানাবাঁধা পর্যায়ে রয়েছে।

এসসময় জমিতে সেচ প্রয়োজন হয়। এ বৃষ্টি সেসব কৃষকের জন্য আর্শিবাদ হয়ে এসেছে। আর মাঠ পর্যায়ে যেসব ধানগাছ নুয়ে পড়েছে, সেসব ধান গাছগুলো ছোট ছোট করে আঁটি বেঁধে তুলে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

ঠাকুরগাঁওয়ে অসময়ের বৃষ্টিতে নুয়ে পড়েছে ধান ক্ষেত

আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপ পরিচালক (ডিডি) মো. আবু হোসেন বলছেন, জেলায় যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে ফসলের খুব একটা ক্ষতি হবে না। অনেক এলাকার ধানগাছ নুয়ে পড়েছে। যেসব ধানগাছে কেবল ফুল এসেছে, তা নুয়ে পড়ায় কিছুটা ক্ষতি হতে পারে।

কিন্তু দেরিতে রোপণ করা আমনের জন্য বৃষ্টি বরং উপকারে আসবে। বৃষ্টি থেমে গেলে নুয়ে পড়া ধানের গাছ আবার নিজে নিজেই দাঁড়িয়ে যাবে। আর বৃষ্টি কমলেই পেকে যাওয়া ধান কেটে নিতে হবে। যে জমি সবজির চারা রোপণের অপেক্ষায় ছিলো, বৃষ্টি সেটার অপেক্ষা আরো বাড়িয়ে দিলা।

পানি নেমে গেলে অধিকাংশ সবজির ক্ষেতের ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে মুলাজাতীয় সবজি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যারা আগাম আলু লাগিয়েছেন, তাদের বপণ করা বীজআলু পঁচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তবে বৃষ্টির কারণে জেলায় ফসলের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা তাৎক্ষনিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি ।