ইমরান হোসেন ইমন, অনুসন্ধানবার্তা :
উত্তরাঞ্চলে শীতকালে প্রতি বছর যমুনা নদীর পানির স্তর কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় শুষ্ক মৌসুমেই উত্তরাঞ্চলের জনপদ মরুভূমিতে পরিনত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইন্সপেকশন অফ ওয়াটার লেভেল মডেলিং (আই,ডব্লিউ,এম) এর গত ৩০ বছরের এক জরিপে এ তথ্য জানাগেছে।
জরিপে জানানো হয়, শুষ্ম মৌসুমে যমুনায় পানি না থাকলে এক সময় উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিনত হতে পারে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান এতথ্য নিশ্চিত করে জানান, আই ডাব্লিউ ওয়াটার মডেলিং জরিপে গত ৩০ বছরের মধ্যে বিগত ১০ বছরে পানির সর্বনিম্ন লেভেল পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, প্রতি বছরই গড়ে শীতকালে পানির নিম্ন প্রবাহ কমে আসছে। বিগত ১০ বছর আগে ২০১০ সালে যমুনার পানির নিচের স্তর ছিল ৯.৬৭ মিটার। এখন ২০২১ সালে শীত মৌসুমে পানির লেভেল দাড়িয়েছে ৯.৪১ মিটার।
২০১১ এবং ২০১২ সালে পানির নিচের স্তর বেড়ে ৯.৭৯ ও ৯.৭২ মিটার হলেও ২০১৭ সালে ৯.১৩ মিটার এবং ২০১৫ সালে ৯.৩৩ মিটার কমে এসেছিল। গড় হিসাবে প্রতি বছরই সর্ব নিম্ন পানি প্রবাহ কমে আসছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, যমুনার তলদেশ এখন বালু স্তর পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। তাই পানি চলে যাচ্ছে। আগের মত পলিও পড়ছে না যমুনায়। চরের যে স্থানে আগে কৃষক ফসল ফলাতো এখন সেটা বালির স্তুপে পরিনত হয়েছে। চর এলাকায় বেড়েছে তাপমাত্রা। তবে যমুনায় শুষ্ম মৌসুমে পানি ধরে রাখতে নদী খননের কোন বিকল্প নেই বলেও জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
ধুনট উপজেলার বৈশাখী চরের বাসিন্দা চাঁন মিয়া ও বাঁধা নগর চরের বাসিন্দা আব্দুল আজিজ জানান, এক সময় যমুনার বৈশাখী ও রাধানগর চরে মানুষের বসতি থাকলেও তা কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে বালি চর জেগে ওঠায় নদীর গতিপথও পরিবর্তন হয়েছে।
আগের দিনে বন্যার পানিতে জমিতে পলি মাটি জমা হওয়ায় চাষাবাদও ভাল হয়েছে। কিন্তু এখন ফসলী জমিতে বালুর স্তুপ জমা হওয়ায় এখন অনেক স্থানেই চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পরিকল্পিতভাবে নদী খনন করা হলে শুষ্ম মৌসুমেও যমুনা তার যৌবন ধরে রাখতে পারবে। এর ফলে আবারও যমুনার চরে ফসল ফলাতে পারবে কৃষকেরা।
সারিয়াকান্দি উপজেলার বোহাইল চরের বাসিন্দা আগজর আলী বলেন, গত কয়েক বছর আগেই পুরো শীতকালেই যমুনাতে পানি থাকতো। কিন্তু বর্তমানে শীতকালের আগেই যমুনা নদীর পানি কমে গেছে। একারনে চর এলাকা বালির স্তুপের কারনে মরুভূমিতে পরিনত হয়েছে। যার কারনে চর এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরো বলেন, কৃষকের জমিতে বলির স্তুপ জমা হলেও স্থানীয় প্রভাবশালীরা বালু উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে চরে কৃষকের ভিটে মাটিও অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে যত্রতত্রভাবে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারি ভাবে নদী খনন করা গেলে একদিকে যেমন চরাঞ্চলের কৃষকেরা ফসল ফলাতে পারবে, অন্যদিকে যমুনা তার যৌবন ফিরে পাবে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ন কবির জানান, যমুনার পানি প্রবাহের ৯৩ শতাংশ উজান থেকে আসে। বাকী ৭ শতাংশ দেশের পানি প্রবাহ থেকেই আসছে।
তিনি জানান, উজানের বিভিন্ন জায়গায় পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, উজানে বৃষ্টিপাত কম হওয়া, যমুনা ভরাট হয়ে গভীরতা কমে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দিন দিন যমুনা নদীর পানি কমে যাচ্ছে। এর ফলে শীতকালে যমুনা নদীর পানির স্তরও কমে যাচ্ছে।
তিনি আরো জানান, বিগত কোন বছরই যমুনায় বর্ষাকালে এত কম পানি দেখা যায়নি। ২০২০ সালে বগুড়া জেলায় কয়েক দফা বন্যা হয়। সেখানে পানির স্তর বিপদসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এবার ২০২১ সালে শুধু একবার বন্যা হলেও পানির লেভেল ছিল বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার উপরে।
বর্ষায় পানি কম হলে এবং নদীর গভীরতা না থাকলে শীতকালে যমুনা নদী পানি ধরে রাখতে পারে না। তাই প্রতি বছরই শুকনো মৌসুমে যমুনার পানি কমে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় এই লেভেল শুণ্যের কোঠায় চলে আসলে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিনত হতে পারে।