আব্দুস সালাম জয়, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: অনুসন্ধানবার্তা
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জে সাধারণ রোগীদের ফাঁদে ফেলে জ্বিন দ্বারা চিকিৎসার নামে এবং নিজ নামের আগে কবিরাজ লাগিয়ে মোঃ মুন্না হাসান ইমন (১৮) নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে।
প্রতারক কথিত এই কবিরাজ কালিগঞ্জ উপজেলার ৩নং কোলা ইউনিয়নের কাদিরডাঙ্গা গ্রামের মন্তেজ আলী এবং ফিরোজা বেগম দম্পতির বড় ছেলে। কথিত জ্বিনের ডাক্তার নামে পরিচিতি পাওয়া মুন্না হাসান ইমনের ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনি রোগীদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার নামে বিভিন্ন এলাকার সহজ-সরল সাধারণ মানুষের নিজের বশে আনা একাধিক জ্বিনের দ্বারা চিকিৎসা প্রদানের কথা বলে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে চলেছেন। তার কাছে আসা রোগীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি। প্রত্যেক রোগীকে প্রথম ৫০ টাকা দিয়ে সিরিয়ালের রশিদ সংগ্রহ করতে হয়। তারপর সিরিয়াল মেনে একটি ছোটো টিনের ঘরে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে মোবাইলবিহীন রোগীকে প্রবেশ করানো হয়। টিনের ঘরে বসে থাকা ভুয়া কবিরাজ মুন্না নানা রকম আয়ুর্বেদিক ও গাছগাছালির ঔষধ, তৈল পড়া, পানি পড়া এবং তাবীজ রোগীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ৫শত থেকে ৭শত টাকা আদায় করে নেন।
এই প্রতারক অধিকাংশ রোগীর কাছ থেকে ৭ শত থেকে ১ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জ্বর, ঠান্ডা, মাথা ব্যথা, হার্টের সমস্যা, টিউমার, জরায়ু, বন্ধ্যাত্বা, মেয়েদের গোপনীয় রোগের জটিল সমস্যা, সন্তান না হওয়া, কানে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, হাঁপানি, এ্যাজমা, পলিপাস, কিডনির সমস্যসহ এমন কোন রোগ নেই যে রোগের চিকিৎসা তিনি করছেন না। আবার তার রোগী দেখার টিনের ঘরের ভিতরে আল্লাহর দান কবিরাজী আয়ুর্বেদিক ও হাকিমি দাওয়াখানা “নামক আরো একটি ব্যানার ও টাঙ্গিয়ে রেখেছেন।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, প্রায় ৫ বছর আগে থেকেই জ্বিন পরীদের মাধ্যমে নানা রকম রোগের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করলেও বর্তমানে তিন মাস হলো শত শত লোকের সমাগম ঘটছে তার বাড়িতে। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত রোগীরা তার বাড়ির উঠান ও আশপাশে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষমান অবস্থায় বসে থাকে কবিরাজকে একবার দেখানোর জন্য। কবিরাজ প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগী দেখেন। তার এই প্রতারণার কাজে তার কৃষক পিতা কৃষি কাজ বাদ দিয়ে কবিরাজী কাজে ছেলেকে সাহায্য করার জন্য নির্দিষ্ট ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে এবং মা ছোট একটি দোকানে তেল, পানির বোতলসহ সিরিয়ালের টোকেন বা টিকিট বিক্রি করে ভুয়া কবিরাজ সাজা ছেলেকে সাহায্য করে থাকেন।
প্রতারক কবিরাজের মা ফিরোজা বেগম বলেন, দূর-দূরান্তের মানুষ রাত ২টা থেকে আসা শুরু করে আমাদের বাড়িতে। সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবার জ্বিনের ডাক্তার বসে আমার ছেলের ঘাড়ে। বাকী দিনগুলো জ্বিনের মাধ্যমে আমার ছেলে কবিরাজী করে থাকে।
পার্শ্ববর্তী জেলা মাগুরার শালিকা থেকে প্যারালাইসিস রোগী হান্নান বিশ্বাসকে তার পরিবারের লোকজন এই কবিরাজের কাছে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। এখানে আগেও দুদিন এনেছেন হান্নান বিশ্বাসকে। অনেক টাকার ওষুধও দিয়েছিল কবিরাজ ছেলেটা। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। তবুও শেষবারের মতো আবার এনেছেন রোগীর সুস্থ হওয়ার আশায়।
কবিরাজের বাড়িতে আসা কালিগঞ্জ উপজেলার মোস্তবাপুর গ্রামের নুর মোহাম্মদ বলেন, আশপাশের লোকের মুখে শুনে আগে একবার এসেছিলাম আমার পাইলসের সমস্যা নিয়ে। সেদিন সব মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার টাকার ঔষধ দিয়েছিল, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তাই আজ আবারও আসলাম, দেখি কি হয়।
তবে এসব বিষয়ে কবিরাজ মুন্না হাসান ইমন বলেন, মানুষের কাজ না হলে এত লোক আমার কাছে আসে কেন? এখানে রোগীদের সাথে কোন প্রতারণা করা হয় না। আমি কিছু না, সব জ্বিনে করে।
এবিষয়ে কোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, আমি শুনেছি অল্প বয়সের এই কবিরাজ প্রতিদিন অনেক রোগী দেখছেন। তিনি কিভাবে কি করছেন তা খোঁজ-খবর না নিয়ে বলতে পারব না। তবে অনিয়ম বা প্রতারণার মত কোন কিছু ঘটলে তা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে যা করনীয় তাই করা হবে ।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আলমগীর হোসেন জানান, জ্বীনের দ্বারা চিকিৎসার বাস্তবিক কোন ভিত্তি নেই। প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে ওই কবিরাজের বাড়িতে গিয়ে তার কার্যক্রম যাচাই করে দেখা হবে।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত জাহান জানান, প্রথমত মানুষকে সচেতন হতে হবে। চিকিৎসার নামে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন কিনা সে ব্যাপারে রোগীদের বুঝুতে হবে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা ওই কবিরাজের ব্যাপারে খোঁজখবর নেব। প্রতারণা এবং অনিয়ম কিছু পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।