জেমস আব্দুর রহিম রানা, যশোর প্রতিনিধি: অনুসন্ধানবার্তা
অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান যশোরের মণিরামপুরে হাত-পা ছাড়া জন্ম নেওয়া লিতুন জিরা একের পর এক পরীক্ষায় মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। অদম্য মেধাবী লিতুন জিরা সদ্য প্রকাশিত এসএসসির ফলাফলেও চমক দেখিয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সে। মণিরামপুর উপজেলার গোপালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় লিতুন জিরা। ভবিষ্যতে এই মেধাবী ও লড়াকু সন্তান সমাজের পিছিয়ে পড়া ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) দুপুরে ফলাফল প্রকাশের পর উচ্ছ্বসিত লিতুন জিরার পরিবার। ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করে লিতুন জিরা জানায়, সে আরও ভালোভাবে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হতে চায়।
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার সাতনল খানপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান ও জাহানারা বেগম দম্পতির দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছোট লিতুন জিরা। বড় ছেলে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। লিতুন জিরা পিইসি (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা) ও জেএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর, প্রাথমিকে বৃত্তি লাভ, শ্রেণির সেরা শিক্ষার্থীর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চায়ও রেখেছে চমক জাগানো অবদান। তার একাগ্রতা আর অদম্য ইচ্ছা শক্তির কাছে হার মেনেছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি বা পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমেও স্বীকৃতি পেয়েছে সে।
জানা যায়, সব বাধা টপকে সমাজের আর জন প্রতিভাবান স্বাভাবিক শিশুর মতোই এগিয়ে চলেছে লিতুন জিরা। বরং এক্ষেত্রে স্বাভাবিক শিশুর চেয়েও দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে সে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে পর পর দুই বছর লিতুন জিরা উপজেলা পর্যায়ে মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রচনা প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন, একই সালে জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় গোল্ড মেডেল অর্জনসহ একই বছরের ৪ জানুয়ারি খুলনা বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পায়।
লিতুন জিরা জানায়, “আমি আরও পড়তে চাই। একদিন চিকিৎসক হবো—সেই স্বপ্ন নিয়েই এগোচ্ছি।” তার সাথে কথা বলে জানা গেল শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে বাধা মনে করেন না সে। বরং নিজের দৃঢ় মনোবল আর ইচ্ছাশক্তিকে হাতিয়ার করে পাড়ি দিচ্ছে প্রতিকূলতার পাহাড়।
মাত্র মুখ দিয়ে কলম ধরে লিখেই সে এর আগেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জেএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে বৃত্তি, ছিল শ্রেণির সেরা শিক্ষার্থী। শুধু পড়ালেখাতেই নয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও পেয়েছে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের স্বীকৃতি।
লিতুন জিরার মা জাহানারা বেগম আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, জন্মের পর মেয়ে লিতুন জিরার ভবিষ্যৎ চিন্তায় অনেক রাত চোখের পানি ফেলেছেন। যার দুই হাত-পা নেই, সেই মেয়ে বড় হয়ে কিই বা করতে পারবে? এমন অজানা শঙ্কায় আঁতকে উঠতেন তিনি। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের পড়ালেখার প্রবল আগ্রহ এবং মেধার স্বাক্ষরতায় সেই আশঙ্কা আজ আশার আলোয় রূপ নিয়েছে তার কাছে।
বাবা কলেজশিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি যে কলেজে চাকরি করেন, দীর্ঘ ১৯ বছরেও সেটি এমপিওভুক্ত হয়নি। তারপরও ছেলে-মেয়েদের কখনো অভাব বুঝতে দেননি। হাঁটাচলা করতে না পারা লিতুন জিরাকে সেই শিশু বয়স থেকে কর্দমাক্ত পথ মাড়িয়ে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হুইল চেয়ারে করে বিদ্যালয়ে নিয়ে গেছেন তিনি। এসএসসিতেও সে প্রত্যাশিত ফলাফল পেয়েছে। এখন কলেজেও তাকে প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। লিতুন জিরা ভবিষ্যতে সমাজের পিছিয়ে পড়া ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সেই স্বপ্ন পূরণে তিনি সবার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেন।
লিতুন জিরা তাদের পরিবারের ছোট সন্তান। তার বড় ভাই ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আর লিতুন জিরা এগিয়ে চলেছে অদম্য সাহস আর অবিরাম স্বপ্ন নিয়ে।
লিতুনের সহপাঠী সজীব হোসেন বলেন, ‘লিতুন জিরা আমার খুব কাছের বন্ধু। সে অত্যন্ত মেধাবী। সে জিপিএ ৫ পাওয়ায় আমরা খুব খুশি। সবাই তার মঙ্গল কামনা করি।’
লিতুন জিরার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গোপালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘লিতুন জিরা অসম্ভব মেধাবী। সে তার শ্রেণিতে শুধু প্রথম নয়, স্কুলের মধ্যেও সে অন্যতম ও অনন্য। শুধু লেখাপড়ায় না, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও অন্যদের চেয়ে ভালো। লিতুনজিরা এবার এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নিয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছে। তার এই ফলাফলে আমরা সকলেই খুশি। তার ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষার জন্য দোয়া ও সাফল্য কামনা করি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্না বলেন, ‘কঠোর অধ্যবসায় ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে যে সব কিছু অর্জন করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত লিতুন জিরা। আমি নেহালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে নিয়মিত লিতুন জিরা’র খোঁজখবর নিয়েছি। তার ফলাফলে অত্যন্ত খুশি হয়েছি। তার এই চমকপ্রদ ফলাফলের খবর পেয়ে আমি নিজে তার বাড়িতে গিয়েছি এবং জেলা প্রশাসকের দেওয়া উপহার বিতরণ করেছি। আমি তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দোয়া ও সাফল্য কামনা করি।