জেমস আব্দুর রহিম রানা: অনুসন্ধানবার্তা
ফের জলাবদ্ধতার শিকার ভবদহ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার। পানিবন্দি অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করলেও মেলেনি এখনও কোনো সরকারি সহায়তা। কম দামে বিক্রি হচ্ছে গবাদিপশু। ভেসে গেছে হাজার হাজার মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে শত শত হেক্টর জমির সবজি ও ফসলি ক্ষেত।
জানা গেছে, যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলাসহ খুলনা জেলার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার পানি নিষ্কাশনের জন্য ১৯৬৮ সালে অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়নের কালিশাকুল গ্রামের ভবদহ নামক স্থানে নির্মিত হয়েছিল ২১, ৯, ৬ ও ২ ভেন্টের স্লুইস গেট। পরবর্তীতে টেকা, পশুর ও শ্রীহরি নদীর নব্যতা কমে যাওয়ায় ১৯৮৫ সাল থেকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা শুরু হয় এ অঞ্চলে। জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সরকার উদ্যোগ নিলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। যে কারণে টানা বৃষ্টিপাত হলেই ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাতে যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার সুন্দলী, চলিশিয়া, পায়রা, মনোহর পুর, কুলটিয়া, দূর্বা ডাঙ্গা, সুফলাকাঠি ও পাজিয়া ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে হাজার হাজার মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে শত শত হেক্টর জমির সবজি ও ফসলি ক্ষেত।
সরেজমিনে বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, বসতবাড়ির উঠানে কোমর পর্যন্ত পানি জমে রয়েছে। ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে মানুষ। গবাদিপশু ও মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করছে।
মনিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর, কপালিয়া, রোজিপুর, ভবানীপুর, খাকুন্দি, হরিনা, বাটবিলা, শ্যামনগর, বাজিতপুর, কোনাখোলা, দত্তকোণা, বিপ্রকোণা, কুলটিয়া, লখাইডাঙ্গা, মশিয়াহাটি, সুজাতপুর, কেশবপুর উপজেলার মনোহর নগর, বাগডাঙ্গা, সানতলা, ময়নাপুর, আড়ুয়া, হদ, মাগুরখালি, ব্রাহ্মণ ডাঙ্গা, পাতরা, ঘাঘা, পাচারই ও অভয়নগর উপজেলার কোটা, চলিশিয়া, বাগদাহ, আন্ধা, বলারাবাদ, বেতভীটা, সরখোলা, ডুমুরতলা, সুন্দলী, ডহর মশিয়াহাটি, বাড়েধা, দীঘলিয়া, ভাটাডাঙ্গী, বারান্দিসহ অর্ধশতাধিক গ্রামের হাজার হাজার পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে।
মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আখতার ফারুক মিন্টু আমাদের প্রতিবেদক জেমস আব্দুর রহিম রানাকে বলেন, আমার ইউনিয়ন ভবদাহ সংলগ্ন হওয়ায় সম্প্রতি অতি বর্ষণ ও নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে ইউনিয়নের বিল সংলগ্ন গ্রাম গুলো সম্পূর্ণ পানির নিচে চলে গেছে। এই এলাকার মানুষের হাজার হাজার মাছের ঘের, ফসলের ক্ষেত ও বাড়িঘর নিমজ্জিত হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এখনো পর্যন্ত দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন ধরনের ত্রাণ সহায়তা পাওয়া যায়নি।
সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বলেন, সম্প্রতি অতি বর্ষণ ও নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে আমার ইউনিয়নের বিল সংলগ্ন গ্রামগুলো জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। কয়েক’শ মাছের ঘের ভেসে গেছে। প্রায় ১২৫ হেক্টর জমির সবজি ও ফসলি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা বা ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে দেখা যায়নি। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য জরুরী ত্রাণ সহায়তার দাবি জানান।
চলিশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সানা আব্দুল মান্নান বলেন, এবারের জলাবদ্ধতায় অভয়নগর উপজেলার সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমার ইউনিয়ন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আজও মেলেনি কোনো সরকারি সহায়তা।’
পায়রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান আত্মগোপনে থাকায় সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে রফিকুল ইসলাম সরদার বলেন, শতাধিক পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। কি পরিমাণ ফসলি ক্ষেত ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে তা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। দ্রুত ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন।
কামাল মোড়ল, মফিজুর রহমান, মনিরুল ইসলাম, খালেক মোড়ল, প্রবির কুমার রায়, সোহাগ বিশ্বাস, আমিনুর রহমান বাঘা, আক্তারুজ্জামান, জালাল মোল্যাসহ ক্ষতিগ্রস্ত ঘের মালিকরা বলেন, অতি বর্ষণ ও উজানের পানির কারণে তাদের হাজার হাজার বিঘা মাছের ঘের ভেসে গেছে।
অভয়নগর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল হক বলেন, অভয়নগরে ৩ ইউনিয়নে ১২০ হেক্টর জমির ৩২০টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি টাকা।
অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লাভলী খাতুন বলেন, রোপা-আমনের ৫৯০ হেক্টরসহ ৩৫ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে।
অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়দেব চক্রবর্তী বলেন, আমি সদ্য যোগদান করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ব্যাপারে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ভবদহের সুইস গেটে ৪টি পানির পাম্প চলমান রয়েছে। এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যা বাস্তবায়িত হলে জলাবদ্ধতার সমাধান হবে।