ইমরান হোসেন ইমন, অনুসন্ধানবার্তা :
বগুড়ার ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। মাত্র ৬ জন চিকিৎসক দিয়েই নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সরকারী এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটার সহ সরকারী কোটি টাকা মূল্যের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে রয়েছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে। করোনাকালেও এই হাসপাতালে মিলছে না কাঙ্খিত সেবা। জরুরী করোনা রোগীদের জন্য নেই কোন প্রস্তুতি! নামে মাত্র একটি করোনা আইসোলেশন কক্ষ থাকলেও কোন রোগী সেখানে ভর্তি হয়নি।
ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, এখানে চিকিৎসা নিতে আসলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। দীর্ঘদিন ধরে সরকারী এই হাসপাতালে চিকিৎসা না পেলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এদিকে কোনও নজরদারি নেই। তাই এ সুযোগে এ সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আশেপাশেই গড়ে উঠেছে অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার। যেখানে সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিৎসরাও রোগী দেখেন। এমন অভিযোগও রয়েছেন অহরহ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধুনট উপজেলার প্রায় ৪ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ধুনট উপজেেলা সদরে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১০টি ইউনিয়নে ৩৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ৪টি সাব সেন্টার রয়েছে।
তন্মধ্যে ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৬ জন মেডিকেল অফিসারের পদ থাকলেও মাত্র ৬ জন মেডিকেল অফিসার রয়েছে। এছাড়া উপসহকারী মেডিকেল অফিসার পদে ১২ জন থাকার কথা থাকলেও মাত্র ২ জন রয়েছে এই পদে।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে মেডিকেল অফিসার একজনও কর্মস্থলে থাকেন না। নির্ধারিত সময়ের পর পরই তারা হাসপাতাল ত্যাগ করেন। অনেকে আবার সপ্তাহে কয়েক ঘন্টা ডিউটি করেন। এ কারনে জরুরী রোগী আসলেই রেফার্ড করে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের বগুড়ার হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে পাঠানো হয়।
মেডিকেল অফিসাররা কর্মস্থলে না থাকায় তাদের জন্য নির্মিত সরকারী ভবনগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এই হাসপাতালে নেই কোন পরিচ্ছন্ন কর্মী। হাসপাতালে প্রবেশ করলেই দেখা যায় নোংড়া পরিবেশ এবং কুকুর বিড়ালের অভয়ারণ্যের দৃশ্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারী এই হাসপাতালে ৫ জন পরিচ্ছন্ন কর্মীর পদ থাকলেও নেই একজনও।
ধুনটের গোপালনগর ইউনিয়নের গৃহবধু রোজিনা বেগম জানান, সরকারী হাসপাতাল হলেও নেই কোন গাইনী ডাক্তার। তারপরও নার্স ও আয়াদের মাধ্যমে গর্ভপাত ঘটানো হয়। অনেক সময় গর্ভপাত ঘটানোর সময় রোগীকে তাৎক্ষনিক রেফার্ড করতে গিয়ে অনেক মা ও নবজাতক শিশু মারাও গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধুনট সরকারী এই হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী জানান, ২০০৪ সালে পাওয়া ৮ লাখ টাকা মূল্যের এক্স-রে মেশিনটি একদিনের জন্যও চালু করা হয়নি। জনবলের অভাবে ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রাফি মেশিনও চালু করা সম্ভব হয়নি। দুটি অপারেশন থিয়েটার থাকলেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সংকটের কারনে তালা বদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অপারেশন থিয়েটারের এসিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তার ও জনবল সংকটের কারনে সরকারের লাখ লাখ টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে।
ধুনট হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, ধুনট হাসপাতালে সার্বক্ষনিক একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সহ কর্মরত ডাক্তারদের থাকার কথা থাকলেও একজনও তাদের কোয়ার্টারে থাকেন না। তাই বহিরাগতরাই ডাক্তারদের এসব ফ্লাটে বসবাস করছেন।
তিনি বলেন, সরকারী এই হাসপাতালে ডাক্তারদের তদারকি করার কোন লোক নেই। একারনে ২৬ জন ডাক্তারের স্থলে ৬ জন থাকলেও তারা নিয়মিত রোগী দেখেন না। ফাঁকে ফাঁকে ক্লিনিকগুলোতে রোগী দেখেন সরকারী ডাক্তাররা। একারনে গোরীব রোগীরা সরকারী চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, এই হাসপাতালে কোন গাইনী ডাক্তার নেই, শিশু ডাক্তার নেই, অর্থোপেডিক ডাক্তার নেই। সরকারী কোটি টাকা মূল্যের অপারেশন থিয়েটার সহ প্রায় সকল যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে রয়েছে। এমননি করোনাকালেও এই হাসপাতালে কোন চিকিৎসা সেবা মেলে না। জরুরী কোন রোগী আসলেই তাদেরকে বগুড়ার হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রেফার্ড করা হয়।
তবে এব্যাপারে ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কর্মকর্তা ডা. হাসিবুল হাসিব বলেন, ডাক্তার ও জনবল সংকটের বিষয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। তারপরও অল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এবিষয়ে ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিভিন্ন সমস্যা বিষয়ে উপজেলা পরিষদের মাসিক মিটিংএ আলোচনা হয়েছে। এবিষয়ে পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব হাবিবর রহমান বলেন, ধুনট সরকারী হাসপাতালের সমস্যা বিষয়ে কেউ অবগত করেনি। কোন সমস্যা থাকলে অবশ্যই খোঁজ নিয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।