যশোর-৫ আসনে নৌকা-ঈগলের লড়াই

জেমস আব্দুর রহিম রানা: অনুসন্ধানবার্তা
জমে উঠেছে যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের নির্বাচন। দিনরাত প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় মুখরিত এই জনপদ। সকাল থেকে গভীর রাত প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। চালাচ্ছেন গণসংযোগ। করছেন নির্বাচনী সভা-সমাবেশ। সমানতালে চলছে মাইক প্রচার আর র‌্যালি।

তবে, সবাই নন, এই আসনে পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র দুইজনকেই সক্রিয় দেখা যাচ্ছে মাঠে। তারা হলেন আসনের বর্তমানসহ দুইবারের এমপি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্ম-বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ও জেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি এসএম ইয়াকুব আলী। স্বপন ভট্টাচার্য্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং ইয়াকুব আলী ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী।

আসনটি থেকে পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বীতায় অবতীর্ণ হলেও মূলত তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে স্বপন-ইয়াকুবের মধ্যে। অন্য তিনজন প্রার্থীর দুজনকে বলা যায় মাঠেই খুঁজে পাচ্ছেন না ভোটাররা। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী এম এ হালিমকে মাঝেমধ্যে একঝলক দেখেছেন বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। ইসলামি ঐক্যজোটের মিনার প্রতীকের প্রার্থী মাওলানা নুরুল্লা আব্বাসির কোনো পোস্টারও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তৃণমূল বিএনপির সোনালী আঁশের মেজর বনির পোস্টার দেখা গেছে কিছু এলাকায়।

গত দুদিন মণিরামপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন নির্বাচন নিয়ে কথা হয় সাধারণ মানুষের সাথে। ভোটারদের কাছে জানতে চাওয়া হয় নির্বাচনী পরিবেশ, ভোটে প্রার্থীদের অবস্থান, আগামী নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের প্রত্যাশা ইত্যাদি। উপজেলার ভবদহপাড়ের হরিদাসকাটি, কুলটিয়া, দূর্বাডাঙ্গা, নেহালপুরের ভোটারদের সাথে কথা বলা ছাড়াও এ প্রতিনিধি কথা বলেন ভোজগাতি, নেহালপুর, ঝাঁপা, খানপুর, শ্যামকুড় এবং মণিরামপুর সদর ইউনিয়নের ভোটার, নির্বাচনী কর্মী ও সমর্থক এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে। সবারই এক কথা এবারের ভোট হবে ‘কড়া’। প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যরে নৌকা আর স্বতন্ত্র এসএম ইয়াকুব আলীর ঈগলের মধ্যে লড়াই হবে সমানে সমান। মূলত পরপর তিনটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যকে এবার শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এসএম ইয়াকুব আলী। তাদের এই ‘লড়াই’ জমিয়ে তুলেছে যশোর-৫ আসনের নির্বাচনী ময়দান। প্রার্থীদের নাওয়া-খাওয়া বলা যায় এক প্রকার হারাম হয়ে গেছে। কদর বেড়েছে ভোটারদের।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার জাকির হোসেন জানান, ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত যশোর-৫ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৫৫ হাজার নয়শ’ ৭৩। তাদের মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৭৯ হাজার চারশ’ ৪৮, নারী এক লাখ ৭৬ হাজার পাঁচশ’ ২৩ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ২ জন। মোট ১২৮টি ভোট কেন্দ্রে সাতশ’ ৯০টি ভোটকক্ষ বা বুথ রয়েছে। তার মধ্যে অস্থায়ী বুথ রয়েছে পাঁচটি।

ভোজগাতি ইউনিয়নের কৃষক শাহিন বলেন, ‘ভোট হবে সমানে সমান। নৌকা আর ঈগলের লড়াই এ কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। কোনো স্থানে নৌকা এগিয়ে আবার কোনো স্থানে ঈগল। তবে, নতুন প্রার্থী হিসেবে এসএম ইয়াকুব আলী যে চমক দেখাচ্ছেন তা পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সরব করে তুলেছে। মূলত তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে মণিরামপুরবাসী একটি জমজমাট নির্বাচন দেখতে পাচ্ছে।’

হরিদাসকাটি ইউনিয়নের যুবক অভিজিৎ মন্ডল বলেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধ দেখিনি। তবে, আমাদের যুদ্ধ প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের। নিজেদের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিবেশ রক্ষার যুদ্ধে ভবদহপাড়ের লাখো মানুষের জীবন আজ অতিষ্ঠ। অনেক নেতা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু ভবদহ সমস্যার বাস্তব সমাধান কেউ করেননি। আগামীতে যারাই নির্বাচিত হবেন তাদের কাছে একটাই দাবি থাকবে তারা যেনো সত্যিকারভাবেই এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন’।

দিগঙ্গা গ্রামের অধিবাসী এই যুবক ক্ষোভের সাথে বলেন, আশা ছিল ভবদহ সমস্যার আশানুরূপ সমাধান হবে। কিন্তু, এখানে প্রকল্পের পর প্রকল্প এসেছে, কাজের কাজ কিছু হয়নি। অভিজিৎ মন্ডলের মতো ভবদহপাড়ের ইউনিয়নগুলোর ভোটাররা একই কথা বলেছেন। তারা বলেন, এই এলাকার মানুষ কোনো ত্রাণ চাননা, কোনো সহযোগিতাও তাদের দরকার নেই। তারা চান জলাবদ্ধ ভবদহকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করে কৃষিসহ অন্যান্য জীবিকার দ্বার উন্মোচন করা হোক। এটা কোনো দান বা দয়া নয়। মানুষের অধিকার। সেই অধিকার বাস্তবায়নের আশায় মানুষ আবারও ভোট দেবে।

তবে, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ভোটের পরিবেশ সুনিশ্চিত হওয়া নিয়ে কিছু সংশয়ের কথা শোনা গেছে। কুলটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রণয় কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘ভোট সুষ্ঠু হলে আমার এলাকায় শতভাগ ভোট কাস্ট হবে। অসুস্থ আর বয়স্ক মানুষকে কোলে তুলে-ভ্যানে চড়িয়ে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু, কেউ কেউ ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করছে। বিশেষ করে ইউনিয়নের শতভাগ হিন্দু ভোটারের তিনটি কেন্দ্র আলীপুর, কুলিটিয়া এবং সুজাতপুর কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ।’ তিনি এসব কেন্দ্রসহ সংখ্যালঘু এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান।

একইভাবে শতভাগ হিন্দু ভোটারের কেন্দ্র দূর্বাডাঙ্গার হরিণা, হরিদাসকাটির পাঁচকাটিয়া কেন্দ্রও। এসব কেন্দ্রেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন প্রণয় কান্তি চৌধুরী।

পল্লী মঙ্গল আদর্শ কলেজের প্রফেসর প্রভাত কুমার মন্ডল বলেন, ‘নির্বাচনী মাঠ শান্তিপূর্ণ। কোনো ঝামেলা নেই। প্রশাসনও তৎপর। আশা করা হচ্ছে ভোট শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই সম্পন্ন হবে।’

নেহালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমএম ফারুক হোসেন অভিযোগ করেছেন, ঈগলের পক্ষে সক্রিয় মাঠে থাকায় তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘৭ জানুয়ারির পর দেখে নেয়া হবে’।
তবে, ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে শ্যামকুড়, রোহিতা, খানপুরসহ কয়েকটি এলাকায়। এসব এলাকার মানুষ বলেছেন, ভোটের পরিবেশ এখনো শান্ত। কোনো প্রকার গোলযোগের খবর পাওয়া যায়নি। তাদের আশা এই অবস্থা ভোটের পরেও বজায় থাকবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার জাকির হোসেন বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র বলতে কিছু নেই। সরকারিভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ কেন্দ্র আছে। তারপরও কোনো প্রার্থীর পক্ষে এখনো পর্যন্ত নির্বাচনী ঝুঁকি নিয়ে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। সেটার কোনো সুযোগও নেই। কারণ প্রশাসন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে সর্বদা সচেষ্ট। এ ব্যাপারে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।’

তিনি জানান, এ পর্যন্ত যশোর-৫ আসনে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘনের দায়ে মোট ২১টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলায় ৮৪ হাজার টাকা, ঈগল প্রতীকের বিরুদ্ধে ৬টি মামলায় ২২ হাজার টাকা, লাঙ্গল ও মিনার প্রতীকের বিরুদ্ধে ১টি করে মামলায় দুই হাজার টাকা করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। একইসাথে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।

সহকারী রিটার্নিং অফিসার বলেন, ভোটের সার্বিক প্রস্তুতি হিসেবে যশোর-৫ নির্বাচনী এলাকায় ২৪টি মোবাইল টিম, পুলিশের ৪টি, র‌্যাবের ২টি, বিজিবির ১টি এবং আনসারের ১টি স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে সক্রিয় থাকবে। সেনাবাহিনীর তথ্য এখনো উপজেলা প্রশাসনের কাছে আসেনি। তবে, উল্লেখিত ব্যবস্থায় রকমফের হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম ইয়াকুব আলী বলেছেন, ‘এ পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসনের ভূমিকা ভালো। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে, প্রতিপক্ষ ঈগলের কর্মী-সমর্থকদেরকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। তারা বাইরের থেকে লোক ভাড়া করে এনে পথে পথে আমার ভোটারদেরকে কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয়ার পরিকল্পনা করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যেয়েও ভয় দেখানো হচ্ছে। ’

তিনি বলেন, ‘শতকরা ৭৫ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে যেতে চান। কিন্তু, ভীতি বা হুমকি থাকলে তা বাধাগ্রস্ত হওয়ার শংকা রয়েছে। এটা হলে প্রধানমন্ত্রীর ভোট উৎসব ব্যহত হবে। এতে লাভবান হবে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। সে কারণে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।’ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ইয়াকুব আলী। তিনি বলেন, ‘মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ভোট দিতে পারলে আমার জয় আল্লাহ ছাড়া কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’

আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী স্বপন ভট্টাচার্য্য সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘যারা এসব বলছেন তারা সঠিক বলছেন না। এই আসনে ভোট হবে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। জাতির জনকের কন্যা আমাকে নৌকা প্রতীক দিয়ে উন্নয়ন আর অগ্রগতির সারথী করেছেন। ফলে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হলে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নৌকাকে বিজয়ী করার কোনো বিকল্প নেই।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ভোটে আমার বিজয় সুনিশ্চিত। মানুষ নৌকায় ভোট দিতে মুখিয়ে আছে। এই ভয়ে প্রতিপক্ষ আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার আর চক্রান্ত চালাচ্ছে।