জামায়াত কর্মী থেকে বগুড়ার ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ সন্ত্রাসী বনে যান নুরু

স্টাফ রিপোর্টার, অনুসন্ধানবার্তা:
বগুড়ার শাজাহানপুরে জামায়াতের কর্মী থেকে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ সন্ত্রাসী নুরুজ্জামান নুরু। নানা অপকর্মের সুযোগ নিতে জামায়াত কর্মী থেকে সরাসরি ক্ষমতাসীন দলে ঢুকে পড়েন তিনি। এলাকার যেকোন অপকর্মেই রয়েছে তার লম্বা হাত। শাজাহানপুর উপজেলায় জমি দখল, ইটভাটায় মাটি সরবরাহ, ইট ও বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, হাটবাজারের ইজারার টেন্ডারবাজি, বিভিন্ন কারখানায় চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, দাদন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও ক্ষমতাসীন দলের নেতা বলে পরিচিত নুরুজ্জামান নুরুর বিরুদ্ধে।

একসময় মাঝিড়া এলাকায় চা দোকানের কর্মচারি থেকে জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন নুরু। পরে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালি নেতা বনে যান তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়ার মাঝিড়া ও আশপাশের কিছু যুবককে দিয়ে বিশাল ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেন নুরুজ্জামান। তারা চাঁদাবাজি, জমি ও বাড়ি দখল, কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করে আসছে। ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পান না। নুরুজ্জামানকে অনেকেই পা কাটা নুরু বলেই জানেন। ১৯৯০ এর দশকে তিনি স্থানিয় এক সন্ত্রাসীর সহচর ছিলেন। এক-এগারোর পর জামায়াত কর্মী থেকে হঠাৎ করেই স্বেচ্ছাসেবকলীগের প্রভাবশালী নেতা বনে যান নুরু। পরে কৌশলে শাজাহানপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন তিনি। বিগত ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে তিনি মাঝিড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

শাজাহানপুরের মাঝিড়াপাড়া এলাকার দিনমজুর নূর আলমের প্রথম পক্ষের ছেলে নুরুজ্জামান নুরু। ২০১৫ সালে শাজাহানপুরের বুড়িতলা এলাকায় যুবলীগ নেতা সাজেদুর রহমানকে (সাজু মিয়া) পা কেটে হত্যার চেষ্টা করে এই নুরু। তখন মাঝিড়া বন্দর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ছিলেন নুরুজ্জামান। গত বছরের মার্চে শাজাহানপুর ইউএনও কার্যালয় থেকে হাটের ইজারার ২২ লাখ টাকার পে-অর্ডারসহ দরপত্র ছিনতাইয়ের নেপথ্যেও নুরুজ্জামানের নাম উঠে আসে। সেই সময় ইউএনও কার্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর মোজাহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে মাঝিড়া ইউপির চেয়ারম্যানের পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এলাকার নানা অপকর্মের নিয়ন্ত্রণ এখন সেই নুরুর হাতেই। শাজাহানপুর উপজেলা সদরের মাঝিড়া থেকে শুরু করে বনানী, ফুলতলা, নয়মাইল, আড়িয়াবাজার, সাবরুলসহ উপজেলাজুড়ে রয়েছে তার ক্ষমতার দাপট। নুরুজ্জামান এক দশকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একাধিক নেতা বলেন, নুরুজ্জামানের বাবা নুরুল আলম পাহারাদার ছিলেন। থাকতেন মাটির ঘরে। কিন্তু নুরুজ্জামান থাকেন মাঝিড়া বন্দরে চারতলা বাসায়। চড়েন পৌনে এক কোটি টাকা দামের দুটি গাড়িতে। বেশ কয়েকটি ট্রাক, একটি ইটভাটা ছাড়াও কোটি টাকার ঠিকাদারি ব্যবসা আছে তার। এছাড়া ডোমনপুকুর এলাকায় প্রায় ৪ একর আয়তনের পুকুরও আছে নুরুর।

গত শনিবার রাতে শাজাহানপুর থানায় ঢুকে অস্ত্র মামলার আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে নুরুজ্জামানসহ ৯ জনকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসতে থাকে তার নানা অপকর্ম। শনিবারের রাতের হামলায় ৮ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনার পর নুরুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১৫টি গুলিসহ দুটি বিদেশি পিস্তল, মাদক ও দেশি অস্ত্র জব্দ করেছে পুলিশ।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে নুরুজ্জামানসহ ৪৫ জনকে আসামি করে পৃথক দুটি মামলা করা হয়। নুরুজ্জামান সহ গ্রেফতার অন্য আসামিরা হলেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান, দপ্তর সম্পাদক বোরহান উদ্দিন, আড়িয়া ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিঠুন হাসান, কর্মী সাদ্দাম রবীন, রমজান আলী, মিরাজুল রহমান, আমিনুল ইসলাম ও মিঠুন মিঞা।

এদিকে এসব ঘটনায় গত রবিবার সন্ধ্যায় নুরুজ্জামানকে শাজাহানপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বরাত দিয়ে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

শাজাহানপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শহীদুল ইসলাম জানান, নুরুজ্জামানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাতেই তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সাতটি গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল জব্দ করা হয়। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হাসান নাজমুলের বাগানবাড়ি থেকে আটটি গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল জব্দ করা হয়েছে। তবে নাজমুল পলাতক রয়েছে। এ ঘটনায় নুরুজ্জামানসহ ৪৫ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এই মামলায় আটক নুরুজ্জামান সহ ৯ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।